ষোল ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে সারেন্ডার হয়, পাকিস্তান যুদ্ধে হেরে যায়, বাংলাদেশ মুক্ত হয়। আমরা সেদিন মুক্তি পাইনি। আমরা মুক্তি পাই ১৭ ডিসেম্বর সকালে। যে মুহূর্তে আমরা মুক্ত হলাম এবং বাসার সৈনিকদের ভারতীয় মিত্রবাহিনী বন্দি করল, তারপর থেকে আমাদের বাসায় দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করল। এর মধ্যে রাসেল মাথায় একটা হেলমেট পরে নিল, সাথে টিটোও একটা পরল। দুইজন হেলমেট পরে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শুরু করল।
আমরা তখন একদিকে মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত আবার আব্বা, কামাল, জামালসহ অগণিত মানুষের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কে বেঁচে আছে কে নেই কিছুই তো জানি না। এক অনিশ্চয়তার ভার বুকে নিয়ে বিজয়ের উল্লাস করছি। চোখে পানি, মুখে হাসি–এই ক্ষণগুলো ছিল অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে, কখও হাসছি কখনও কান্নাকাটি করছি। আমাদের কাঁদতে দেখলেই রাসেল মন খারাপ করত। ওর ছোট্ট বুকের ব্যথা আমরা কতটুকু অনুভব করতে পারি? এর মধ্যে কামাল ও জামাল রণাঙ্গন থেকে ফিরে এসেছে। রাসেলের আনন্দ ভাইদের পেয়ে, কিন্তু তখন তার দু’চোখ ব্যথায় ভরা, মুখফুটে বেশি কথা বলত না। কিন্তু ওই দুটো চোখ যে সব সময় আব্বাকে খঁজে বেড়াচ্ছে তা আমি অনুভব করতে পারতাম।
আমরা যে বাসায় ছিলাম তার সামনে বাড়িভাড়া নেওয়া হলো। কারণ এত মানুষ আসছে যে বসারও জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে আমাদের ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসা লুটপাট করে বাথরুম, দরজা-জানলা সব ভেঙে রেখে গেছে পাকসেনারা। মেরামত না হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি আব্বা ফিরে এলেন বন্দিখানা থেকে মুক্তি পেয়ে। আমার দাদা রাসেলকে নিয়ে এয়ারপোর্ট গেলেন আব্বাকে আনতে। লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল সেদিন, আব্বা প্রথম গেলেন তার প্রিয় মানুষের কাছে। তারপর এলেন বাড়িতে। আমরা সামনের বড় বাড়িটায় উঠলাম। ছোট যে বাসাটায় বন্দি ছিলাম সে বাসাটা দেশ-বিদেশ থেকে সব সময় সাংবাদিক ফটোগ্রাফার আসত আর ছবি নিত। মাত্র দুটো কামরা ছিল। আব্বার থাকার মতো জায়গা ছিল না এবং কোনও ফার্নিচারও ছিল না। যা হোক, সব কিছু তড়িঘড়ি করে জোগাড় করা হলো।
রাসেলের সব থেকে আনন্দের দিন এলো যেদিন আব্বা ফিরে এলেন। এক মুহূর্তে যেন আব্বাকে কাছছাড়া করতে চাইত না। সব সময় আব্বার পাশে পাশে ঘুরে বেড়াত। ওর জন্য ইতোমধ্যে অনেক খেলনাও আনা হয়েছে। ছোট সাইকেলও এসেছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরপরই ও আব্বার কাছে চলে যেত।
সূত্রঃ শেখ হাসিনার লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বই হতে সংগৃহীত